মানবতার ধর্ম ইসলাম বিপন্ন ও অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানো ঈমানী দায়িত্ব
মানবতার ধর্ম ইসলাম বিপন্ন ও অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানো ঈমানী দায়িত্ব
গাজী মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম জাবির ।।
ইসলাম মানবতার ধর্ম। শান্তি, সৌহার্দ্য, সাম্য-মৈত্রী, সহনশীলতা, পরমতসহিষ্ণুতা, উদার-নৈতিকতা, মূল্যবোধগত উৎকর্ষতা, অসাম্প্রদায়িকতা , মানবিকতা হলো ইসলামের ইসলামের অন্যতম আদর্শ। ইসলাম প্রবর্তনের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট বিচার-বিশ্লেষণ করলেই পুতঃপবিত্র এই জীবন-বিধানের নান্দনিক ও সৌন্দর্যময় চরিত্রের বহিঃপ্রকাশ পরিলক্ষিত হবে, ইনশাআল্লাহ। সর্বপ্রকার হিংস্রতা, নিষ্ঠুরতা আর পাশবিকতার বিপরীতে মানবতাবাদী ইসলামের কল্যাণধর্মী প্রকাশ ঘটে। সারা বিশ্বে অমানবিকতার সব ধরনের রেকর্ড যখন অতিক্রান্ত হয়ে গিয়েছিল, তখনই ইসলাম তার সর্বমানবিক রূপটি নিয়ে বিশ্বমানবতার জন্য আবির্ভূত হয়। জেহালতের অন্ধকার ভেদ করে ইসলাম তার মানবিকতার স্পর্শে সব মানুষকে আপন করে নেয়। ব্যক্তি-আক্রোশ, পারিবারিক বিরোধ, সামাজিক বৈষম্য আর জাতি-ধর্মের সব ভেদাভেদ দূর করে সাম্য-মৈত্রী আর বিশ্বভ্রাতৃত্বের আদলে এক আদর্শস্থানীয় শান্তিময় সমাজ-কাঠামো গড়ে তোলে। অতি অল্প সময়ের ব্যবধানে ইসলামের দ্রুত প্রসারের মূলে যে কয়টি অনুষঙ্গ কার্যকর ভূমিকা রেখেছে তার অন্যতম হলো সমাজে মানবিক মূল্যবোধের উপস্থিতি ও তার সফল প্রয়োগ। ইসলামের মানবতাবাদী আদর্শ সমকালীন ব্যক্তি ও সমাজ-মানসের ইতিবাচক পরিবর্তনে অনবদ্য অবদান রাখে।
ইসলামী জীবনদর্শনে বিশ্বমানবতাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে। মানবসভ্যতায় সম্প্রীতির পৃথিবী আর সর্বজনীনতার প্রকৃষ্ট নজির স্থাপন করেছে ইসলাম। ইরশাদ হচ্ছে- ‘আল ইয়াওমা আকমালতু লাকুম দিনাকুম ওয়া আতমামতু আলাইকুম নিমাতি ওয়া রাদিতু লাকুমুল ইসলামা দিনা’, অর্থাৎ আজ আমি তোমাদের জীবনব্যবস্থাকে পরিপূর্ণ করে দিলাম, তোমাদের ওপর প্রদত্ত আমার অনুগ্রহকেও সম্পূর্ণ করে দিলাম আর তোমাদের জন্য জীবন পদ্ধতি হিসেবে ইসলামকেই মনোনীত করে দিলাম। মানবজাতির জন্য মহান স্রষ্টার মনোনীত এই ইসলামের মূল মর্মবাণীই হচ্ছে কল্যাণকামিতা, মানবিকতা। বলা হচ্ছে- ‘আদ্দিনু ওয়ান্নাসিহা’ অর্থাৎ ইসলাম এমন এক ধর্ম, যা সর্বদাই কল্যাণের কথা বলে, মানবিকতার জয়গান গায় এবং ভালোবাসার পূর্ণতা দান করে। পবিত্র কোরআন এবং মহানবী (সা.)-এর প্রতিটি বাণী ও বক্তব্যে বিশ্বমানবতার প্রকৃত স্বরূপ পরিস্ফুট হয়ে ওঠে। কোরআনে কারিমকে বলা হয় ‘হুদাল্লিন্নাস’ তথা গোটা মানবতার জন্য পথপ্রদর্শক আর মহানবী (সা.)-কে বলা হয় ‘রাহমাতুল্লিল আলামিন’ তথা গোটা বিশ্ববাসীর জন্য করুণাস্বরূপ। এতে ইসলামের সর্বজনীন এবং বিশ্বজনীন রূপটিই স্বমহিমায় প্রকাশিত হয়ে থাকে এবং মানবতার পরিশুদ্ধ সুরতটিই তাতে ফুটে ওঠে।
ইসলামের ইতিহাসের বিখ্যাত পয়গম্বর হযরত ইব্রাহিম (আ.) যিনি মুসলিম নামটির প্রবর্তন করেছেন, তার জীবনের একটি শিক্ষণীয় ঘটনায় ইসলামে মানবিকতার বিষয়টি সুন্দরভাবে ফুটে ওঠে। ইব্রাহিম (আ.)-এর স্বভাব ছিল মেহমান নিয়ে খাবার গ্রহণ করা। কোনো একসময় এমন হলো যে, তিনি মেহমান পাচ্ছেন না; এতে করে তিনি খাদ্য গ্রহণও করছেন না। অবশেষে মেহমান একজন এল, তিনি পরমানন্দে আগন্তুক মেহমান নিয়ে খাবার খেতে বসলেন এবং মেহমানকে প্রভুর নামে খেতে বললেন। মেহমান এতে বিরক্তি ও অপারগতা প্রকাশ করে খাবার না খেয়েই চলে যেতে উদ্যত হলে প্রিয় নবীর প্রতি প্রত্যাদেশ এল মেহমানকে তার ইচ্ছামতো খাদ্য গ্রহণের স্বাধীনতা দিতে। নবী তাই করলেন, মেহমান খাবার খেয়ে যাওয়ার সময় নবীকে এর কারণ জানতে চাইলে বিষয়টি তার কাছে ব্যক্ত করা হলো এবং সে তখন অজ্ঞানতা আর খোদাবিমুখতার পথ পরিহার করে নিজেকে শুধরে নিল। মানবতার পরম সুহৃদ হযরত মোহাম্মদ (সা.)-এর উপস্থিতিতে মসজিদে অমুসলিম জনৈক ব্যক্তি প্রস্রাব করতে উদ্যত হলে সাহাবিরা যখন এর সমুচিত জবাব দিতে প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, দয়ার নবী তখন তাদের থামিয়ে দিলেন। লোকটি কাজ সেরে যখন চলে যাচ্ছিল, তখন নবীজি তাকে বুঝিয়ে বললেন- এটি আমাদের উপাসনার জায়গা, যা আমাদের কাছে খুবই পরিচ্ছন্ন ও পবিত্র। এখানে ময়লা হলে আমাদের কষ্ট লাগে। ওই ব্যক্তি যা প্রমাণ করতে এসেছিল তা সে পেয়ে গেল। অর্থাৎ শেষ জমানার পয়গম্বর যিনি হবেন, তিনি চরম ধৈর্যের পরাকাষ্ঠা বহন করবেন। আর সেটি প্রমাণের জন্যই তার অনাকাঙ্ক্ষিত কাজটি করা, প্রমাণ শেষে একত্ববাদের কালেমা পড়ে তিনি মহাসত্যে ঈমান আনয়ন করলেন। নবীজির বাড়িতে মেহমান এল, যাদের ধর্মবিশ্বাসের সঙ্গে নবীজির মতদ্বৈততা রয়েছে। কিন্তু মেহমানের আতিথেয়তা ইসলামের অমোঘ বিধান। নবীজি সাহাবিদের মেহমান ভাগ করে দিলেন এবং নিজেও তার বাড়িতে আপ্যায়নের জন্য একজনকে সঙ্গে নিলেন। রাতের খাবার পরিবেশিত হলো মেহমানের সামনে, এতই খেল যে, অতিরিক্ত খাদ্য গ্রহণের ফলে তার পেট খারাপ করল। নবীজির ঘর ও বিছানা নোংরা হলো। মেহমান প্রত্যুষের আগেই নবীগৃহ ত্যাগ করল। সকালবেলা মেহমানকে ওঠাতে গিয়ে নবীজি দেখলেন সে নেই এবং যা ঘটেছে তা তিনি ধৈর্যসহ প্রত্যক্ষ করলেন। বিছানা, ঘর নিজ হাতে পরিষ্কার করলেন। বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে কয়েকজন সাহাবিসহ নবীজি যখন এই ঘটনায় আফসোস করছিলেন, তখনই দেখতে পেলেন মেহমান ওদিকে আসছে। কিন্তু তার মধ্যে খুব ভয়, নবীজি তাকে অভয় দিলেন। সামনে আসার পর নিজ হাতে মেহমানের রেখে যাওয়া তরবারিটি ফেরত দিয়ে বললেন- রাতে আমার বাড়ির খাবার খেয়ে তোমার পেট খারাপ করেছে, আমাকে জাগালেই পারতে। আমি তোমার চিকিৎসার ব্যবস্থা করতাম। তোমার অসুস্থতায় আমি কোনো সেবাই করতে পারলাম না এ জন্য তুমি আমার প্রতি কোনো কষ্ট পোষণ করো না, আমাকে মাফ করে দিও। মেহমান ভাবতে লাগল, যার একটা হুকুমে এই মুহূর্তে আমার তরবারি দিয়ে আমারই মস্তক দ্বিখণ্ডিত হয়ে মরুভূমির তপ্ত বালিতে গড়াগড়ি খেতে পারে, সেই মানুষ আমার সঙ্গে কতই না মানবিক আচরণ করছেন। নবীজির মহানুভবতায় মুগ্ধ-বিহ্বল হয়ে তরবারিটি প্রিয় নবীর পায়ে ফেলে মেহমানের কণ্ঠে উচ্চকিত হলো তাওহিদের কালেমা। এসব দৃষ্টান্তে ইসলামের মানবিকতা এবং মূল্যবোধ আপন আলোয়ে ফুটে ওঠে।
মহানবী (সা.) ইসলামের আলোকে যে সমাজ গড়ে তুলেছিলেন তার ভিত্তি ছিল সততা, ন্যায়বিচার, পারস্পরিক সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি ও মানবিকতাবোধ। ইসলামে পঞ্চস্তম্ভের অন্যতম প্রধান হলো নামাজ, আর সেই নামাজের মাধ্যমে আমরা মানবিকতা আর সাম্যের এক প্রকৃষ্ট নজির দেখতে পাই। একই কাতারে আমির-ফকির, সেখানে মানুষ হিসেবে কোনো ভেদাভেদ থাকে না। নবীজি তার এক বাণীতে বলেছেন- ‘মানুষের প্রতি যে ব্যক্তি দয়া বা অনুগ্রহ প্রদর্শন করে না, মহান আল্লাহ তার প্রতিও করুণা প্রদর্শন করবেন না।
তিনি আরও বলেছেন, সমগ্র সৃষ্টিই হচ্ছে মহান আল্লাহর পরিবারভুক্ত। আর তাই সৃষ্টিকুলের মাঝে সেই মহান আল্লাহর কাছে সবচেয়ে অধিক প্রিয় যে তার পরিবারের সঙ্গে সদ্ব্যবহার করবে। মহানবী (সা.) মক্কা বিজয়ের পর যারা তার সঙ্গে অতীতে চরম দুর্ব্যবহার করেছিল, নিষ্ঠুরতা প্রদর্শন করেছিল, তাদের সবার প্রতি তিনি মানবিক আচরণ করেন। চরম দুঃসময়ে, যুদ্ধের ময়দানে, এমনকি শত্রুর সঙ্গেও তিনি মানবিক আচরণের ধারা বজায় রেখেছেন। মক্কা বিজয়ের পর এক বৃদ্ধাকে তিনি দেখতে পেলেন ভারী এক বোঝা বহন করে দূর পাহাড়ের দিকে যাচ্ছেন। দয়ার নবী বুড়ির কাছ থেকে বোঝাটি নিজের মাথায় উঠিয়ে নিলেন এবং তার গন্তব্যে পৌঁছে দিলেন। বিদায়বেলায় বুড়ি অবাক-বিস্ময়ে মক্কার পাশবিক ও রুক্ষ সমাজে এমন বিনয়ী, পরোপকারী মানুষের সন্ধান পেয়ে হতবিহ্বল হয়ে পড়েন। কৌতূহলভরে জিজ্ঞেস করে যখন দয়াল নবীর পরিচয় পেলেন, বুড়ি তখন আর চোখের পানি সংবরণ করতে পারেননি। চিৎকার করে আর আত্মবিশ্বাসভরে তিনি বলতে লাগলেন- ‘এই যদি হয় মোহাম্মদ (সা.)-এর মানবিক চরিত্র, তবে তিনি কোনো মানুষেরই ক্ষতি করতে পারেন না।’ আর হ্যাঁ, তিনি কারও ক্ষতি করতে আসেননি, তিনি এসেছেন মানবিকতা, সম্প্রীতি আর পরোপকারিতার মাধ্যমে সর্বোন্নত ও মহত্তম এক মানবিক বিশ্ব গড়ে তোলার প্রত্যয় নিয়ে; যেখানে তিনি সর্বোতভাবে সফল হয়েছেন।
রাসুলে পাকের উপরোক্ত শিক্ষা অনুযায়ী বিপন্ন মানবতার পাশে দাঁড়ানো আমাদের কর্তব্য। শীতের সময় অসহায় শীতার্ত সহ দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রায় সময়ই নানাবিধ দুর্যোগ নেমে আসে। অগ্নিকাণ্ড, অনাবৃষ্টি বা ভয়াবহ বন্যার কারণে সৃষ্ট দুর্যোগে দুর্গত মানুষের ভোগান্তি ও কষ্ট সীমাহীন পর্যায়ে পৌঁছে। এমতাবস্থায় বিপন্ন ও দুর্গত মানবতার পাশে দাঁড়ানো আমাদের সবার নৈতিক, ঈমানি দায়িত্ব হয়ে পড়ে।
সরকারের বিভিন্ন সংস্থা, সংগঠন থেকে শুরু করে নানা স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান তখন আর্তমানবতার পাশে দাঁড়ায়, সাধ্যমতো সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়। স্রষ্টাকে পেতে হলে আগে তার সৃষ্টিকে ভালোবাসতে হবে, সৃষ্টির সেবায় আত্মনিয়োগ করতে হবে। মহানবী (সা.) বলেছেন, তোমরা দুনিয়াবাসীর প্রতি রহম করো, আকাশবাসী (আল্লাহ) তোমাদের প্রতি অনুগ্রহ করবেন। সুতরাং নানা ধরনের দুর্যোগে আর্তমানবতার পাশে সেবার মানসে নিজেদের বিলিয়ে দেয়া, দুর্গত মানুষদের ওপর আসা বিপদাপদ ও সমস্যাসংকুল অবস্থায় আন্তরিক হয়ে দায়িত্বশীলতার সঙ্গে তাদের খেদমতে নিয়োজিত হওয়াই ইসলামে শ্রেষ্ঠ ইবাদত হিসেবে পরিগণিত হয়। আল হামিদুল্লাহ।
সুফি সমাজে একটি কথা প্রচলিত আছে, খেদমাতে খোদা মিলে ইবাদাতে জান্নাহ অর্থাৎ সেবায় মহান আল্লাহ সন্তুষ্ট হন আর আল্লাহর বন্দেগিতে বান্দার জন্য জান্নাত নিশ্চিত হয়। সুতরাং মানবতার সেবাই গুরুত্বপূর্ণ; যার পরিপ্রেক্ষিতে স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা সন্তুষ্টি হন। বলাবাহুল্য, মহান আল্লাহ কারও প্রতি সন্তুষ্ট থাকলে তার আর কী-ই বা প্রয়োজন হয়!
অর্থ-বিত্ত, শক্তি-সামর্থ্য ও সহায়-সম্পত্তির সাময়িক সময়ের জন্য মালিকানা দেওয়া হয়েছে মানুষকে। মহান আল্লাহ তায়ালা এসবের মাধ্যমে মানুষকে পরীক্ষা করে থাকেন। যারা তা যথাযথ পন্থায় কাজে লাগায় তারা সফল। অন্যথায় কিয়ামতের দিন এজন্য তাদের বিচারের মুখোমুখি হতে হবে। সুতরাং, মহান আল্লাহ তায়ালা আমাদের প্রত্যেককে ইসলামের সঠিক দর্শন বুঝার এবং মানবিক ও সামাজিকভাবে আলোকিত, শান্তিময় দেশ ও সমাজ গঠনের তাওফিক দান করুন, আমিন।।
নিউজটি আপডেট করেছেন : Banglar Alo News Admin
কমেন্ট বক্স